গামছা দেখে তাঁরা বুঝেছেন আমিও বাঙালি
- আপডেট সময় : ০৮:২৫:৫৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ৬৪ বার পড়া হয়েছে
৫ মে সকালে সাড়ে সাতটায় আমরা ছমরংয়ের উদ্দেশে ট্রেকিং শুরু করি। প্রথম ১০ মিনিট একেবারে খাড়া চড়াই ধরে উঠি, তারপর ৩০ মিনিট অনেকটা নেমে যেতে হয়। জায়গাটার নাম পুরোনো ঘানড্রুক। এখান থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে উঠে যে জায়গায় পৌঁছই, তার নাম কিম্রুংধারা। তারপর আবার এক ঘণ্টা উতরাই পথে নিচে নেমে একটা সবুজ উপত্যকায় একেবারে নদীর কাছে পৌঁছে যাই। ঝুলন্ত ব্রিজ ধরে যে নদী পার হই, তার নাম কিম্রুংখোলা। নদীর ওপার থেকে ক্রমাগত উঁচুতে উঠতে হয়। দুই ঘণ্টা চড়াই পথ পার হয়ে আমরা পৌঁছই দুর্বিনধারা।
একবার উন্মাদ হিসেবে স্বীকৃতি পেলে সবকিছু সহজ হয়ে যায়
সারা সকাল রোদের মধ্যে হেঁটেছি, জ্যাকেট ও ফ্লিসের জামা খুলে রেখে শুধু টি-শার্ট পরে হেঁটেও আমার অনেক গরম লাগে। টি-শার্ট ভিজে গিয়েছে। কপাল ও মুখের ঘাম গামছা দিয়ে মুছি। দুপুরে খাওয়ার জন্য যেখানে থামি, সেখানে বয়োজ্যেষ্ঠ এক বাঙালি দম্পতির সঙ্গে দেখা হয়। কলকাতার বাঙালি। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। বললেন, আমার ব্যাকপ্যাকের সঙ্গে বাঁধা গামছা দেখে তাঁরা বুঝেছেন আমিও বাঙালি। জানতে চাইলেন কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি। তাঁরা মচ্ছপুছারে বেজক্যাম্প পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছেন। অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু যেতে পারেননি। এখন ঘোরেপানি ও পুনহিল যাবেন। তাঁরাই বললেন, এই পথে বেশ কজন বাংলাদেশি নারী-পুরুষের দেখা পেয়েছেন তাঁরা।
এই দুজনের বয়স আমার চেয়ে যথেষ্ট কম বলে মনে হয়। তাহলে তাঁরা কেন অত দূর গিয়েও অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প পর্যন্ত যেতে পারলেন না, সে প্রশ্ন করতে গিয়েও একটু ইতস্তত করলাম।
দুপুরের পর অল্প কিছুক্ষণ হাঁটতে হবে। এখানে ট্রেকিংয়ের পথ বেশ কঠিন হলেও পুরোটাই গাছের ছায়ায়। এ অরণ্যে রডোডেনড্রন যেমন আছে, তেমনি আছে বড় বড় ওকগাছ। একটু পরই শুরু হয় বৃষ্টি। প্রথমে সামান্য, তারপর একেবারে অঝোর ধারায়। আমার ব্যাকপ্যাক প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে নিতে হয়। তার ওপর পরে নিই একটা রেইনপঞ্চো। ব্যাকপ্যাকের ভেতরে পাসপোর্ট, ওয়ালেট ও ওষুধপথ্য যেন না ভেজে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকি। গাছের ওপর থেকে আমার মাথা ও গায়ে বৃষ্টির পানি পড়ে, পাতা ঝরে পড়ে। নিচে ট্রেকিংয়ের পথের মাটি ও পাথর ভিজে গিয়েছে বলে পিছলে পড়ার আশঙ্কা। ঝরা পাতার ফাঁকে থাকতে পারে জোঁক। আগের বছর পুনহিল ট্রেকের রক্তঝরা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। জোঁকের ভয়ে সাবধানে তাকাই, সন্তর্পণে পা ফেলি।
হিমালয়ের এই পার্বত্য পথে বসন্তের আবহাওয়া যতই আরামদায়ক হোক, হাঁটতে গেলে গরম লাগে। দুপুরে ছিল অসহনীয় গরম। এখন বৃষ্টির পর অনেক বেশি ঠান্ডা হয়েছে চারদিক। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ছমরংয়ের গেস্টহাউসে পৌঁছে যাই। জিনিসপত্র ঘরে রেখে ফ্রেশ হয়ে জ্যাকেট পরে বাইরে আসতে না আসতেই দেখি রোদ উঠেছে। সঙ্গে মিহি বৃষ্টির ছাঁট। আর আমাদের গেস্টহাউসের বারান্দার ঠিক সামনে, যেন পাহাড়েরই গায়ে ফুটে উঠেছে অসাধারণ সুন্দর একটা রংধনু। আসলে দুটি রংধনু। ওপরেরটা একটু হালকা আর নিচেরটা উজ্জ্বল রঙিন। বেশ কজন নারী-পুরুষ সেই রংধনুর ছবি তুলতে চেষ্টা করছেন। আমিও কয়েকটা ছবি তুলি। কোনো ছবিতেই ওই স্বর্গীয় দৃশ্য যথেষ্ট ভালোভাবে ধারণ করা যায় না।
হিমালয়ের প্রকৃতি এমনিতেই অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। তার ওপর পাহাড়ের পটভূমিতে ও রকম জোড়া রংধনু অসামান্য একটি দৃশ্য। সচরাচর এ রকম দেখা যায় না। জোড়া রংধনুকে যত বিরল মনে করা হয়, আসলে তত বিরলও এটি নয়। বৃষ্টির ফোঁটার ওপর সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে রংধনু সৃষ্টি হয়। একই বৃষ্টির ফোঁটার ওপর সূর্যের আলো দুবার প্রতিফলিত হলে তৈরি হয় জোড়া রংধনু। এমনিতেই রংধনুকে পবিত্র স্বর্গীয় উপহার বলে মানেন এখানকার অনেকে। তার ওপর জোড়া রংধনু মানেই সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির ইঙ্গিত। এ রকম জোড়া রংধনু দেখতে পাওয়া মানে একটা শুভসূচনা। যাঁরা এটা দেখবেন, তাঁদের প্রাচুর্যের দিন সমাগত। ওই রংধনুর যত খুশি ছবি তোলা যাবে, তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করা যাবে। কিন্তু ওদিকে আঙুল তোলা বা হাত দিয়ে দেখানো শিষ্টাচারসম্মত হবে না। এই অপূর্ব দৃশ্যের মধ্যে এমনিতেই পবিত্রতার ছোঁয়া আছে। আমি যথাসাধ্য শিষ্টাচার মেনে চলি। এখন কিছু সমৃদ্ধি বা প্রাপ্তিযোগ ঘটলে মন্দ হয় না। সে রকম কিছু না পেলে আপাতত এইটুকু চাই, যেন জোড়া রংধনু দেখার পর আমাদের বাকি যাত্রা এমনই বর্ণময় ও শুভ হয়। সুস্থ শরীরে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে নিরাপদে ফিরে আসতে চাই।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রংধনু যারা দেখছে, তাদের মধ্যে মালিনকে দেখতে পাই না। ঘানড্রুক থেকে আমার একটু আগে ও বের হয়েছিল। দুপুরে একই জায়গায় লাঞ্চ করলাম আমরা। তাহলে দিনের শেষে ও কোথায় গেল? এত সুন্দর রংধনু ও দেখতে পেল কি? তেজ বলল, ওরা আজ ছমরং ছাড়িয়ে সিনুওয়া পর্যন্ত গিয়ে থামবে। এতে একটু এগিয়ে থাকল বলে কাল ট্রেকে ওর সময় লাগবে কম।