অস্তিত্ব সংকটে সদরঘাট
- আপডেট সময় : ০৮:০৫:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ৬৩ বার পড়া হয়েছে
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এলাকা সদরঘাট। এক সময়ের ব্যস্ততম এলাকাটি এখন মৃতপ্রায়। উনিশ শতকে বিভিন্ন নদী পরিবাহিত পণ্য, বিশেষ করে মাছ, শাকসবজি ও ফলের সুবিশাল সব আড়ত সদরঘাট কেন্দ্রিক গড়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা শহরের নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকেন্দ্র ছিল এই সদরঘাট।
দেশের সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এক সময়ের বাণিজ্যিক কেন্দ্রটি এখন জৌলুস হারাচ্ছে। এখন কারওয়ানবাজার, যাত্রাবাড়ী, আমিনবাজারসহ কয়েকটি বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে ওঠায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে সদরঘাট। একই সঙ্গে কমেছে নৌপথ কেন্দ্রিক যাতায়াত। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘুরানো এই এলাকাটিকে পরিকল্পিত উপায়ে সাজাতে না পারলে এটি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
সদরঘাট আদি ঢাকা শহরের একটি নদীবন্দর যাকে ঘিরে উনিশ শতকে একটি ব্যবসায়িক জনপদ গড়ে ওঠে। এই নদীবন্দরটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। একবিংশ শতকের শুরুতেও এটির গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। সদরঘাটকেন্দ্রিক শ্যামবাজার, বাদামতলিসহ কয়েকটি বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠেছিল। দেশের অন্যতম প্রধান নৌঘাটটি পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে যেমন সুযোগ-সুবিধা তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তার অনেক কিছুই এখন এখানে অনুপস্থিত। অবকাঠামোগতভাবে পিছিয়ে থাকা নদীবন্দরটির সবখানেই দৈন্যের চিত্র। যাত্রী বা পণ্য পরিবহন কোনোটির জন্যই সময়োপযোগী পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই এখানে। কাল পরিক্রমায় ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলো এখন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কিছু অংশ যাত্রাবাড়ী, কারওয়ানবাজার ও গাবতলী আমিনবাজারসহ কয়েকটি স্থানে গড়ে উঠেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সদরঘাটে লঞ্চের সাইরেন ও কুলিদের হাঁকডাক এখন আর শোনা যায় না। পুরো নিস্তব্ধ সদরঘাট এলাকা। যাত্রী সংকটে দিনের বেলায় বরিশাল ও চাঁদপুরগামী কোনো লঞ্চ ছেড়ে যায় না। অন্যান্য রুটে কয়েকটি লঞ্চ ছেড়ে গেলেও তা আগের তুলনায় অনেক কম। একই সঙ্গে পণ্য পরিবহনেও নির্ভরতা কমেছে সদরঘাটে। পাইকার সংকটে পণ্য কমেছে শ্যামবাজারে। পিঁয়াজের আড়ত, শাক-সবজি, পান সুপারিসহ বিভিন্ন কাঁচামালের প্রধান আড়ত ছিল এই শ্যামবাজার। এখন অনেকটাই জৌলুস হারিয়েছে। রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাটের পার্শ্ববর্তী শ্যামবাজার, বাদামতলি, সোয়ারিঘাটে পণ্য নিয়ে আসা নৌকা ও ট্রলারের শ্রমিক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে হতাশার গল্পই। তাদের মতে, ২০ বছর আগেও নদীপথে পণ্য পরিবহনে রমরমা অবস্থা ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জৌলুস হারিয়েছে নৌপথে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা। বর্তমানে মূলত নদীকেন্দ্রিক বাজারগুলোতে নৌপথে মালামাল পরিবহন করা হয়। তবে তার প্রায় শতভাগই কৃষিপণ্য। মূলত প্রান্তিক যেসব এলাকায় সড়কপথে এখনো যোগাযোগ সুবিধা উন্নত হয়নি, সেসব এলাকা থেকে কেবল মালামাল পরিবহনে নৌপথের ব্যবহার হয়। শ্যামবাজার ঘাটের নৌকার মাঝি কলিম মিয়া বলেন, ‘জোয়ান বয়স থেকেই এই ঘাটে নৌকা চালাই। আমার বাপেও এ ঘাটে নৌকা চালাতো। এই শ্যামবাজার ঘাটে আগে যে পরিমাণ মাল নৌকায় আসতো এখন তো আগের মতো আসে না। আমরাও বড় নৌকায় আলু, পিঁয়াজ নিয়ে বিভিন্ন ঘাটে গেছি। চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা থেকে নৌকায় মাল আসা দেখছি। এখন তো আর সেই অবস্থা নাই। সব ট্রাক, পিকআপে আসে।’
শ্যামবাজারে নৌকায় পণ্য ওঠানামার কাজ করেন সিরাজগঞ্জে সকদার মিয়া। তিনি বলেন, ‘৩০ বছর এই বাজারে পণ্য ওঠানামার কাজ করছি। কিন্তু প্রথম দিকে এই শ্যামবাজারে প্রচুর মালামাল আসতো। এখন খুবই কম। তবে বরিশাল কেন্দ্রিক কিছু শাকসবজি এই বাজার থেকে নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। আসে খুবই কম। সব পণ্য এখন সড়কপথে আসে।’ এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ-এর যুগ্মসচিব সদস্য (পরিকল্পনা ও পরিচালন) মো. সেলিম ফকির এনডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার সদরঘাট। একসময় দক্ষিণবঙ্গের প্রধান যাতায়াত ব্যবস্থার কেন্দ্র ছিল এটি। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক কেন্দ্রও ছিল। কিন্তু এখন জৌলুস অনেকটা কমেছে। কারণ যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির কারণে সাধারণ মানুষের যাতায়াত ও বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহন সড়কপথে হয়ে থাকে। তবে নতুন করে সদরঘাট নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। সদরঘাটকে কীভাবে সাজানো যায় সেটা নিয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ সভা হয়েছে। যেহেতু মাত্র কিছুদিন হলো পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে, আপতত এ বছর যাক। পরবর্তীতে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করে কী করা যায় সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করা হবে।’ এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘এক সময়ের বাণিজ্যিক হাব ছিল সদরঘাট। পদ্মা সেতুসহ সড়কপথের উন্নয়নের কারণে সদরঘাটের চিরচেনা হাঁকডাক অনেকটা কমেছে। তবে সরকারকে এটা নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা করা দরকার। আর নৌপথ বিশ্ব বাণিজ্যর অন্যতম একটি পথ। বিশ্বের সব দেশই এই পথকে শক্তিশালী করেছে। সরকারকেও এ বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। এর মধ্যে সদরঘাটসহ পুরান ঢাকাকে পুনরায় উন্নয়ন করে সাজাতে হবে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে। একই সঙ্গে পুরান ঢাকাকে যদি ট্যুরিজম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করি তাহলে সদরঘাটকে উন্নয়ন করতেই হবে। সরকারকে নৌপথ ও সড়কপথের সমন্বয়ে সদরঘাটকে বাণিজ্যিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
Source: অস্তিত্ব সংকটে সদরঘাট